
কক্সবাংলা ডটকম :: দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আপাতত ঋণের অর্থ ছাড় করবে না বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। আগামীতে নির্বাচিত সরকার আসার পর ঋণ দেওয়ার বিষয়টি ভেবে দেখবে বলেও স্পষ্ট করেছে আইএমএফ।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব জানা গেছে।
গত ১৩ থেকে ১৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ‘ঋণের অর্থ ছাড়-সম্পর্কিত’ একাধিক বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা এভাবে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। ওই কয়েক দিনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গেও একাধিক বৈঠকে বসে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল।
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে এবারের বাংলাদেশ প্রতিনিদলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমানসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেকে ছিলেন। এবারের ওয়াশিংটন ডিসি সফর নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে এসব জানা যায়।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভার বাইরে সাইড লাইনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে এই দুই সংস্থা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে চার চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায় ও বিনিয়োগ বাড়ানো।
এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলে অর্থনীতির অন্যান্য সূচকেও ভারসাম্য আসবে বলে জানানো হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে সরকার কী কী করছে তা জানিয়ে বলেছে, বিগত সরকারের দুর্নীতি অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, সরকার আইএমএফের শর্ত পূরণে জোর চেষ্টা করছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে যতটা গতি আসার কথা, তা আসছে না। এতে রাজস্ব আদায়েও আশানুরূপ গতি আসছে না। সরকারের আয় না বাড়ায় দেশি-বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। মনে রাখতে হবে, আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিশোধের নিশ্চয়তা না পেলে ঋণ দেওয়া পিছিয়ে দেবে এবং এটিই স্বাভাবিক।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওয়াশিংটনে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আগামী ডিসেম্বরেই ঋণের কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে আলাদাভাবে এক বৈঠকে বসবেন। ওই বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, অনেক শর্ত এখনো পূরণ হয়নি।
ব্যাংক খাতে অস্থিরতা কাটছে না। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি রয়েছে। রাজস্বসহ অন্যান্য সংস্কারও আশানুরূপ নয়। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থ খাতের স্থিতিশীলতা আশানুরূপ না থাকায় নির্বাচনপূর্ব সময়ে আইএমএফ ঋণের ছাড় দিতে রাজি হয়নি।
এ বৈঠক শেষে গভর্নর সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, ‘রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, ডলার স্থিতিশীল। আইএমএফের নীতি-সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ, তবে তাদের অর্থ ছাড়া দেশ চলবে।’
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদও সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘আইএমএফ যদি কঠিন শর্ত আরোপ করে, বাংলাদেশ তা মানবে না। এখন দেশ আগের মতো সংকটে নেই।’
সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে আইএমএফ তাদের শর্ত বাস্তবায়নে চাপ তৈরি করেছে। নতুন সরকার এলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে পরে ঋণ ছাড়তে চায় সংস্থাটি। নির্বাচিত সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ঋণের ষষ্ঠ কিস্তি না দেওয়ার কথা জানিয়েছে আইএমএফ।
নতুন সরকারের সঙ্গে আলোচনার পর সংস্কার কর্মসূচি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি মিললেই কিস্তির অর্থ ছাড় করা হবে। ষষ্ঠ কিস্তিতে আইএমএফ থেকে প্রায় ৮০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা থাকলেও আপাতত তা পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি এবারের সফরে।
আইএমএফ থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১ বার ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে সাত কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এর অন্যতম শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়ন করা। এ আইন করতে দেরি করায় শেষের দুই কিস্তি আটকে দিয়েছিল আইএমএফ। এবারেও শর্ত পূরণ করতে না পারায় ঋণের কিস্তি আটকে দেওয়া হয়েছে।
আগামী ২৯ অক্টোবর আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদলের দুই সপ্তাহের জন্য ঢাকায় আসার কথা আছে। ওই দলটির সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বৈঠক করবে।
আইএমএফ দলটি বাংলাদেশে থাকবে দুই সপ্তাহ। এবারের বৈঠকে ঋণ কিস্তি ছাড়ের বিষয়ে অনুরোধ করা হবে বলে জানা যায়। এরই মধ্যে এনবিআর থেকে রাজস্ব ঘাটতি পূরণে করণীয় নির্ধারণ-সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে।
আইএমএফ থেকে এবারে ঋণ দেওয়ার শুরুতেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল।
এনবিআরের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা শুল্ককর আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। পরে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আইএমএফ ৩ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা আদায়ের কথা বললেও আদায় হয় ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা।
আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করার শর্ত দেয়। এই শর্ত পূরণ করতে হলে ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করা প্রয়োজন থাকলেও তা পারেনি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অতিরিক্ত রাজস্ব ৭৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে আদায়ের কথা থাকলেও আদায় হয়নি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
এই অর্থবছরে অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এরই মধ্যে রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি আছে। সব মিলিয়ে তিন অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে। এবারের ওয়াশিংটনের বৈঠকে রাজস্ব আদায়ের পর্যায়ক্রমে এসব হিসাব তুলে ধরে রাজস্ব ঘাটতির কারণ এবং লক্ষ্যমাত্রা পূরণের নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে।
এবারের সফরে অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একক হারে ভ্যাটের হার বাস্তবায়নে চাপ দিয়েছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক। এ হার কার্যকর করা না হলে ঋণের কিস্তির বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি না বলেও সংস্থা দুটি থেকে জানানো হয়েছে। সংস্থা দুটির এমন চাপের মুখে বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা একক ভ্যাটের হার বাস্তবায়নে যাব। যদিও দেশের ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের একক হারের পক্ষে নেই।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘ভ্যাটের একক হার কার্যকর করা হলে দেশের ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়বেন। ব্যবসায় খরচ বাড়বে। জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আইএমএফের চাপে এটি বাস্তবায়ন না করার দাবি জানাই।’
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, আইএমএফের ঋণের অর্থ সরকারের প্রয়োজন রয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে রাজস্ব আদায়ে সরকার পিছিয়ে রয়েছে। অনেক শর্ত এখনো পূরণ করতে না পারলেও রিজার্ভ বেড়েছে, ডলারের ক্ষেত্রেও শর্ত পূরণ করেছে। প্রবাসী আয় বেড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে সরকার দর-কষাকষি করতে পারবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাতে, রাজস্ব ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার এখনো সফল হয়নি। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এসেও আসছে না। এসব বিষয় নিয়ে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে। তবে এটিও ঠিক যে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে চেষ্টা করছে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল থেকে বিগত সরকারের দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেছে। বিগত সরকারের সময়ে পাচার করা অর্থ উদ্ধারে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।
জানানো হয়েছে, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুবিধা দিতে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন পর্যন্ত করা হয়েছে। রাজস্ব অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের আয় কমেছে। ব্যাংক ও আর্থিক খাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারকে বিশেষ সুবিধা দিতে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজস্বমুক্ত সুবিধা দেওয়া আছে- এমন দেশে অর্থ পাচার করে পরে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

Posted ৯:৪৮ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta